বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই বড় দল —
আওয়ামী লীগ (AL) বিএনপি (BNP)
এই দুই দলের মধ্যে বিরোধের কারণে একাধিকবার একতরফা নির্বাচন হয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন: বিএনপি ও তাদের জোট অংশ নেয়নি, কারণ তারা চেয়েছিল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। ফলে আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়, এবং অনেক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীই ছিল না। ২০২৪ সালের নির্বাচন: বিএনপি ও কিছু দল আবারও নির্বাচন বর্জন করে; আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্র দলগুলো অংশ নেয়।
প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোতে কোনো বড় দল ছাড়া নির্বাচন হতে পারে, কিন্তু সেটি গণতান্ত্রিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে যদি সব দল অংশ না নেয়।
অনেক বিশ্লেষক বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন (inclusive election) ছাড়া জনগণের সত্যিকারের মতামত প্রতিফলিত হয় না।
আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন হলে সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রভাব কী হতে পারে” — এটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল একটি বিষয়।
যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে —
বাংলাদেশের সবচেয়ে সংগঠিত ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল অনুপস্থিত থাকবে। ফলে সংসদে একতরফা বা দুর্বল বিরোধী দল-নির্ভর সরকার গঠিত হতে পারে। এতে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কারণ আওয়ামী লীগের সমর্থকরা (যারা দেশের একটি বড় অংশ) নির্বাচনের ফলাফল মেনে নাও নিতে পারে।
অশান্তি, আন্দোলন, সহিংসতা, প্রশাসনিক অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে।
আন্তর্জাতিকভাবে ও দেশের অভ্যন্তরে এই ধরনের নির্বাচনকে “অংশগ্রহণহীন” বা “একতরফা” নির্বাচন হিসেবে দেখা হবে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ সাধারণত অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন হলে সেই বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
সরকার গঠিত হলেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও কূটনৈতিক চাপ বেড়ে যাবে।
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হতে পারলেও, জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ না থাকলে সাংবিধানিক বৈধতা তর্কসাপেক্ষ হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর (বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন) নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা সরাসরি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে:
বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ স্থগিত বা প্রত্যাহার করতে পারে। টাকায় চাপ, শেয়ারবাজারে অস্থিরতা, এবং বাণিজ্যে ক্ষতি হতে পারে।
ফলাফল: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।
বাংলাদেশের রাজনীতি আগে থেকেই মেরুকৃত (polarized)। আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন হলে এই বিভাজন আরও গভীর হবে — মানুষ রাজনৈতিকভাবে “পক্ষ–বিপক্ষ” এ বিভক্ত হয়ে পড়বে।
ফলাফল: সামাজিক সংহতি দুর্বল হবে, পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়বে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধিকবার এমন নির্বাচন হয়েছে — দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন
তৎকালীন সরকার ছিল বিএনপি (খালেদা জিয়া) নেতৃত্বাধীন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ প্রায় সব বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করে।
ফলাফল:
প্রায় একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ৩০০টির মধ্যে ২৭৮টি আসন পায়, কারণ প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ ছিল না প্রায়। ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম (২০–২৫% অনুমান করা হয়)।
পরিণতি:
দেশে প্রবল আন্দোলন, সহিংসতা ও হরতাল শুরু হয়। মাত্র এক মাসের মধ্যে সরকার সংসদ বিলুপ্ত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। পরবর্তী ১২ জুন ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।
শিক্ষা: একতরফা নির্বাচন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না; রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়ায়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন
তৎকালীন সরকার ছিল আওয়ামী লীগ (শেখ হাসিনা) নেতৃত্বাধীন। বিএনপি, জামায়াত, ও বেশিরভাগ বড় দল নির্বাচন বর্জন করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে।
ফলাফল:
১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পান আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা। ভোটার উপস্থিতি ছিল আনুমানিক ৩৯–৪০%। হাজারেরও বেশি ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
পরিণতি:
আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত নির্বাচন (জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করে)। আওয়ামী লীগ সরকার টিকে যায়, কিন্তু রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। বিএনপি ও বিরোধীদলগুলো ২০১৫ সালে বড় আন্দোলন করে, যা দমন করা হয়।
শিক্ষা: একতরফা নির্বাচন সরকারকে ক্ষমতায় রাখলেও রাজনৈতিক বিভাজন গভীর করে।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন
বিএনপি ও কয়েকটি বড় দল নির্বাচন বর্জন করে; দাবি ছিল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আওয়ামী লীগ অংশ নেয় এবং তাদের কিছু ছোট মিত্র দলও নির্বাচন করে।
ফলাফল:
আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে জয়ী, বাকিগুলো ছোট দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ভাগ হয়। ভোটার উপস্থিতি সরকারিভাবে প্রায় ৪০%, তবে বাস্তবে আরও কম বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।
পরিণতি:
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নির্বাচনটি অংশগ্রহণহীন ও প্রতিযোগিতাহীন হিসেবে বিবেচিত হয়। বিএনপি রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখে, কিন্তু সরকারের নিয়ন্ত্রণ শক্ত থাকে।
শিক্ষা: অংশগ্রহণহীন নির্বাচন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনে না, বরং গণতন্ত্রের গুণগত মান কমায়।
১৯৯৬, ২০১৪, ও ২০২৪ — এই তিনটি নির্বাচন মিলিয়ে দেখলে একটা স্পষ্ট প্যাটার্ন বা শিক্ষা পাওয়া যায় 🤯😔
বাংলাদেশে “একপক্ষীয়” গণতন্ত্র টেকসই নয়। যখনই এক বড় দল নির্বাচন থেকে দূরে থাকে, নির্বাচন তার অর্থপূর্ণতা হারায় — ভোটার অংশগ্রহণ কমে, জনআস্থা নষ্ট হয়। জনগণের আস্থা হারানো মানেই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। নির্বাচনের পরে বিরোধিতা, সহিংসতা, ও আস্থাহীনতার চক্র নতুন করে শুরু হয়। গণতন্ত্র মানে প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা ছাড়া “নির্বাচন” হয়তো আইনগতভাবে সঠিক, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে “গণতান্ত্রিক” হয় না।
আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন: বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ”?